বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে গবাদি পশু আবহমান কাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। “আমার সন্তান থাকে যেন দুধে ভাতে” গ্রামাঞ্চলে মায়েদের এবং নানী দাদিদের মুখে প্রচলিত এ প্রবাদ বাক্যটি আমরা প্রায় শুনে থাকি। আর এ কারণে গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই অন্তত একটি বকনা বা দুধের গাভী পালন করা হয়। গাভীর দুধ বিক্রি পরিবারের সদস্যদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করে অনেক পরিবারই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলাদেশের দেশী গাভীর দুধ উৎপাদন অত্যন্ত কম, দিনে গড়ে ১-২ লিটার। তাই দেশের গবাদি পশুর জাত উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে সারা দেশে ব্যাপকভাবে কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ কার্যক্রম শুরু হয়। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর প্রোটিনের চাহিদা পূরনের জন্য প্রয়োজন অধিক উৎপাদনশীল ও উন্নত জাতের পশু সম্পদ। পশু সম্পদের কৌলিগত উন্নয়নের জন্য “কৃত্রিম প্রজনন” হচ্ছে একটি পুরাতন কিন্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ একক কৌশল।
কথিত আছে যে, খ্রীষ্টের জন্মের ১৩০০ বছর আগে জনৈক আরব বিজ্ঞানী ঘোড়ার বেলায় কৃত্রিম প্রজনন করে সফলতা অর্জন করেন। ইতালীয় বিজ্ঞানী স্নেসেঞ্জানী ১৭০০ খ্রীস্টাব্দে কুকুরে কৃত্রিম প্রজনন করে কৃতকার্য হন। পাক-ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম কৃত্রিম প্রজনন করানো হয় ১৯৩৯ সালের দিকে। আমাদের দেশে গবাদি পশু উন্নয়নের মাধ্যমে বেশী দুধ ও মাংস পাওয়ার জন্য সরকার কৃত্রিম প্রজনন প্রথম চালু করে ১৯৬০ সালের দিকে। কৃত্রিম প্রজননের কার্যক্রমের মাধ্যমে গাভীর জাত উন্নয়নের একটি জলন্ত প্রমাণ হল বাংলাদেশ দুগ্ধ সমবায় সমিতির (মিল্ক ভিটা) অধীনস্থ এলাকাগুলো। ১৯৮৭ সালের প্রথম দিকে মিল্ক ভিটার অধীনস্থ এলাকাগুলোতে কৃত্রিম প্রজননের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে লাইভস্টক ফিল্ড এসিস্ট্যান্ট (খঋঅ) হিসাবে মাঠে কাজ করতে দেওয়া হয়। এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আজ থেকে ২৫/২৬ বছর আগে যে গাভী দুধ দিত ২ থেকে ৩ লিটার আজ সে গাভীর বংশধরগণ প্রতিদিন দুধ দিচ্ছে ১৮ থেকে ২০ লিটার।
প্রজনন পদ্ধতি: গবাদি পশুর প্রজননের জন্য ২ টি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। যেমন:
প্রাকৃতিক প্রজনন: যে পদ্ধতিতে কোন ষাঁড়ের দ্বারা সরাসরি গাভীকে প্রজনন করানো হয়।
কৃত্রিম প্রজনন: যে পদ্ধতিতে ষাঁড়ের সিমেন বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত সিমেন দ্বারা (গরম হওয়া) গাভীকে কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন করানো হয়।
প্রাকৃতিক প্রজনন ও কৃত্রিম প্রজননের মধ্যে পার্থক্য:
প্রাকৃতিক প্রজনন | কৃত্রিম প্রজনন |
---|---|
প্রাকৃতিক প্রজননে গাভীর আঘাত পাওয়ার সম্ভবনা থাকে। | আঘাত পাওয়ার সম্ভবনা থাকে না। |
ইনব্রিডিং হওয়ার সম্ভবনা থাকে। | সম্ভাবনা নেই কারণ পূর্ব পুরুষের রেকর্ড থাকে। |
প্রাকৃতিক প্রজননে ব্যবহৃত ষাঁড় এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। | সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ নেই। |
যৌন রোগ সমূহ যেমন ক্যামফাইলোব্যাকটার, ট্রাইকোমোনাস, ব্রুসোলোসিস ইত্যাদি সংক্রমিত হতে পারে। | কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহ্নত বীজ এবং যন্ত্রপাতি বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর করা সম্ভব। |
কৃত্রিম প্রজনন কি: যে পদ্ধতিতে ষাড়, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি হতে সিমেন সংগ্রহ করে গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক মতে পদ্ধতিগত করার পর কৃত্রিম উপায়ে গাভী, ছাগী ও ভেড়া ইত্যাদির জরায়ুতে প্রবেশ করানো হয় তাকে কৃত্রিম প্রজনন বলা হয়।
কৃত্রিম প্রজনন এমন একটি কৌশল যার মাধ্যমে-কৃএিমভাবে ষাঁড় থেকে বীর্য সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত বীর্যের গুণাগণ পরীক্ষা করা হয়। বীর্যকে তরল ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়।গাভী/বকনা গরম হলে কৃত্রিম উপায়ে গাভী/বকনার জরায়ুতে সংগৃহীত বীর্য (ংবসবহ) প্রবেশ করানো হয়।
কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা:
১) ভাল গুণ সম্পন্ন ষাঁড়ের বীর্য দিয়ে অতি দ্রুত ও ব্যাপক ভিত্তিতে উন্নত জাতের গবাদি পশু তৈরী করা সম্ভব।
২) ষাঁড় থেকে একবার সংগৃহীত সিমেন দ্বারা ১০০-৪০০ গাভী প্রজনন করা যায়। ফলে ষাঁড়ের ব্যবহার উপযোগীতা বৃদ্ধি পায়।
৩) বীর্যের গুণাবলী পরীক্ষা করা হয় বলে গর্ভধারনের সম্ভবনা বেশী থাকে।
৪) ষাঁড় থেকে গাভীতে সংক্রামক রোগ (যেমন ট্রাইকোমোনিয়াসিস, ভিব্রিওসিস ইত্যাদি) বিস্তার প্রতিহত করা যায়।
৫) কম খরচে অনেক বেশী গাভীকে পাল দেওয়া যায়।
৬) ষাঁড়ের জন্মগত ও বংশগত রোগ বিস্তার প্রতিরোধ করা যায়।
৭) সঙ্গমে অক্ষম উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করা যায়।
৮) যে কোন সময় যে কোন স্থানে সহজেই কৃত্রিম প্রজনন করা যায়।
৯) উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য সংগ্রহ করে পরবর্তীতে অনেক সময় পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
১০) অনেক সময় বড় আকারের ষাঁড় দিয়ে ছোট আকারের গাভীকে পাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। কৃত্রিম প্রজনন দ্বারা এ অসুবিধা দুর করা যায়।
১১) এক স্থান হতে অন্য স্থানে গাভী বা ষাঁড় পরিবহনের খরচ ও ঝামেলা পোহাতে হয় না।
১২) উন্নত পালন পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক পরিসংখ্যান রাখা যায়।
১৩) ভিন্ন ভিন্ন জাতের গবাদি পশুর মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করা যায়।
১৪) বিদেশী ষাঁড় আমদানী না করে বিশেষ বৈজ্ঞানিক উপায়ে জমাট বাঁধানো সিমেন আমদানি করেও প্রজনন করা যায় এবং এ বীজ ১৫-২০ বৎসর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
১৫) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উন্নত জাতের ষাঁড় নির্বাচন করা যায়।
১৬) এ পদ্ধতিতে শুক্রানুর গুনাগণ পরীক্ষা করা যায়।
কৃত্রিম প্রজননের অসুবিধা/সীমাবদ্ধতা:
১) দক্ষ ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অপারেটর এবং বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়।
২) যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে পরিস্কার করা না হলে গাভীর গর্ভধারনের সম্ভবনা কমে যায়।
৩) প্রাকৃতিকভাবে পাল দিলে যে সময় লাগে তার চেয়ে এই পদ্ধতিতে বেশী সময়ের প্রয়োজন হয়।
৪) প্রজননের জন্য রক্ষিত ষাঁড়ের বিশেষ পরিচর্যার প্রযোজন হয়।
৫) গাভীর উত্তেজনা কাল সুষ্ঠুভাবে নির্ণয় করতে হয়।
৬) গর্ভবতী গাভীকে ভুলক্রমে জরায়ুর গভীরে প্রজনন করালে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
৭) স্বাভাবিক প্রজননের চেয়ে অধিক সময়ের দরকার হয়।
৮) কৃত্রিম প্রজননের জন্য সহায়ক গবেষণার প্রয়োজন হয়।
৯) কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশী।
১০) গাভীর প্রজনন অঙ্গের গঠন ও কার্যাবলী সর্ম্পকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকতে হবে।
কৃত্রিম প্রজননের প্রয়োজনীয়তা: কৃত্রিম প্রজননের প্রয়োজনীয়তা ইতিমধ্যে উপরে কিছুটা আলোচনা হলেও নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য করলেই এর গুরুত্ব আরো অনুধাবন করা যাবে।
া দেশে মোট গবাদি প্রাণির ৪৬% (উখঝ-২০১৬) কৃত্রিম প্রজননের আওতায় আসে নি।
া দেশে দুধ ও মাংসের ঘাটতির কারণে দেশের অনেক মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে।
া প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে দুধের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার গুড়ো দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি আমদানির জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে থাকেন।
া দেশীয় গাভীর দৈনিক উৎপাদন ১-৩ লিটার অপরদিকে
বিদেশী উন্নত জাতের উৎপাদন ১০-৪০ লিটার।
া দেশীয় গরুর দৈহিক ওজন ১৫০-২৫০ কেজি অপরদিকে বিদেশী উন্নত জাতের গরুর দৈহিক ওজন ৫০০-১০০০ কেজি।
া গবাদি প্রাণীর মাংসের চাহিদা বেশি থাকলেও প্রাপ্তি কম বিধায় দাম তুলনামূলকভাবে বেশী।
কৃত্রিম প্রজনন প্রয়োগ কৌশল/পদ্ধতি: কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিটি মূলত: কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। ধাপগুলো নিম্নে প্রদত্ত হল:
১ম ধাপ: সিমেন সংগ্রহ: সিমেন সংগ্রহের তিনটি পদ্ধতি আছে। যথা:
ক. ম্যাসেজ পদ্ধতি: হাত দ্বারা ম্যাসেজ করে ষাড়কে উত্তেজিত করা হয়।
খ. ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন পদ্ধতি: এক ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্র ষাড়ের মলদ্বারে প্রবেশ করে স্টিমুলেশন করা হয়।
গ. আর্টিফিসিয়াল ভ্যাজাইনাল পদ্ধতি: এ পদ্ধতিটি সবচেয়ে সহজ এবং প্রচলিত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে আর্টিফিসিয়াল ভ্যাজাইনা দিয়ে ডামি ষাঁড় ব্যবহারের মাধ্যমে সিমেন সংগ্রহ করা হয়। কোনস, রাবার ক্যাথেটার, সিমেন কালেকশন টিউব, পিচ্ছিলকারক জেলী এবং ৪২-৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানি দিয়ে আর্টিফিসিয়াল ভ্যাজাইনা তৈরি করা হয়।
২য় ধাপ: সিমেন মূল্যায়ন: দুইভাবে সিমেন মূল্যায়ন করা হয়।
ক. বাহ্যিকভাবে সিমেন মূল্যায়ন: প্রতিবার ইজাকুলেশনে ৩-৫ মি.লি. সিমেন হবে। সিমেনের রং ক্রিম হোয়াইট হবে। সিমেনের ঘনত্ব গাঢ় হবে। সিমেনের মান একটিভিটি ভাল হবে।
খ. পরীক্ষাগারে সিমেন মূল্যায়ন: প্রতি মি.লি. সিমেনে ৫০০ মিলিয়ন শুক্রাণু থাকবে। সিমেনে ১৫-২০% এর বেশী মৃত্যু
শুক্রাণু থাকা যাবে না। শুক্রাণুর নাড়াচাড়ার গতি ৬০ ভাগ থাকতে হবে।
৩য় ধাপ: তরলীকরণ ও সংরক্ষণ: সিমেনের তরলীকরণ ও সংরক্ষণের দুইটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। এগুলো হল:
ক. তরলীকৃত সিমেন রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রা সংরক্ষণ পদ্ধতি।
খ. তরলীকৃত সিমেন ডীপ হিমায়িত সংরক্ষণ পদ্ধতি।
৪র্থ ধাপ: সিমের ইনসেমিনেশন: এ ধাপে সংরক্ষিত সিমেন গাভীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রথমে সংরক্ষিত সিমেন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থোয়িং করে নিতে হবে। পরর্বতীতে সিমেন প্লাস্টিক ইনসেমিনেটর টিউবে নিতে হবে। বাম হাতে গাভীর পায়ুপথে ঢুকিয়ে জরায়ুর গ্রীবা ধরতে হবে। ডান হাত দিয়ে সিমেন ভর্তি ইনসেমিনেটর টিউব স্ত্রী জননাঙ্গের জরায়ুতে প্ররেশ করানোর পর সিমেন প্রতিস্থাপন করতে হবে।
কৃত্রিম প্রজননে কি কি নিয়ম মেনে চলা উচিত:
১) গাভী গরম বা ডাকে আসছে কিনা তা ভালভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে।
২) গাভীকে প্রজননের পূর্বে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে শুক্রাণু (ঝঢ়বৎস) জীবিত আছে কিনা দেখে নিতে হবে।
৩) গাভী দুর থেকে প্রজননের জন্য নিয়ে আসা হলে এক থেকে দেড় ঘন্টা বিশ্রাম দিতে হবে।
৪) গাভীকে ট্রাবিসের মধ্যে আটকাতে হবে।
৫) গাভীর যৌনদ্বার দুই আঙুল দিয়ে ফাঁক করে শুকনা তুলা দিয়ে ভালভাবে পরিস্কার করে নিতে হবে।
৬) প্রজনন কাজ কোন চালার নিচে বা গাছের নিচে অর্থাৎ ছায়াযুক্ত স্থানে করতে হবে।
৭) প্রজনন টিউব বা ক্যাথেটার দ্বারা এক সিসি পরিমাণ সিমেন নিয়ে গাভীর জরায়ুতে প্রবেশ করাতে হবে। মলনালী দিয়ে বা হাত ঢুকিয়ে জরায়ুর গলা ধরতে হবে এবং ডান হাতে মূত্রনালী দিয়ে আস্তে আস্তে প্রজনন টিউবটি জরায়ুর গলা দিয়ে প্রবেশ করে মাঝামাঝি স্থানে সিমেন ঢেলে দিতে হবে।
৮) প্রজনন টিউব একবারের বেশী ব্যবহার করা উচিত নয়।
৯) গাভী কোন কারণে পাল না রাখলে ২১ দিনের মাথায় আবার ডাকে আসবে এবং পুনরায় প্রজননের পূর্বে যোনী দ্বার ভাল করে পরীক্ষা করতে হবে। কোন রোগের উপসর্গ যেমন যোনী দ্বারে গটি বা লাল হওয়া বা ফুলে উঠা ইত্যাদি দেখা না দিলে দ্বিগুণ মাত্রায় সিমেন দিয়ে প্রজনন করতে হবে। (চলবে..)