ডিম হলো আমাদের খুব পরিচিত সব রকমের পুষ্টি উপাদানের ভরপুর একটি প্রাকৃতিক খাবার। ডিমকে আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাওয়ার হাউজ বলা হয়। সব বয়সের মানুষের জন্য ডিম অত্যন্ত উপকারী খাদ্য। তাই আমাদের সুস্থতার জন্য প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়া আবশ্যক। ডিমে সব ভিটামিন থাকায় বিজ্ঞানীরা একে সুপার ফুড (Super Food) হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাই তারা শিশুসহ সব বয়সীদের বেশি পরিমাণে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
তবে উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে সুপার ফুড খাওয়ার প্রবণতা কম। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুরা রাতকানা, রক্ত স্বল্পতা, হাড্ডিসার, গা ফোলা বা কোয়াশিওরকর রোগে ভোগে। তবে ডিমের পরিপূর্ণ উপকার পাওয়ার জন্য আমাদের নিয়ম মেনে ডিম খাওয়া দরকার। উন্নত দেশগুলোতে সকাল বেলা নাস্তার সময় মানুষ একসাথে দুইটি ডিম খেয়ে থাকে। দুটো মাঝারী আকারের ডিম একত্রে খেলে মানব দেহের জন্য দৈনিক প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি এর ৮২%, ফলিক এসিডের ৫০%, রাইবোফ্লাভিনের ২৫% সেলেনিয়ামের ৪০% এই ডিম থেকে পূরণ করা সম্ভব।
অনেক সময় খিদে বেশি থাকার কারণে আমরা বেশি খেয়ে ফেলি। প্রধানত, বেশি খাওয়ার কারণেই ওজন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ডিম আমাদের খিদে কমিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করবে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিম খেতে পারেন। গবেষণায় দেখা যায় সকালে একটি ডিম খাওয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে দিনে প্রায় ৪০০ ক্যালরি কমানো সম্ভব। নিয়মিত সকালে ডিম খেলে মাসে প্রায় ৩ পাউন্ড ওজন কমানো সম্ভব। সকালে একিট ডিম আপনাকে সারা দিন কাজ করতে সাহায্য করবে। ডিম আমাদের দেহে ক্যালোরি সরবরাহের মাধ্যমে শক্তি দেয়।
ক্যান্সার প্রতিরোধ ও শরীর গঠন করে ডিম
ক্যানসার একটি মারাত্মক ব্যাধি। ডিমে থাকা ভিটামিন-ই আমাদের ত্বক এবং কোষের ফ্রি র্যাডিকেল ধ্বংস করে এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আমাদের শরীর গঠন করতে সাহায্য করে। বাড়ন্ত বয়সে কন্যা শিশুদের নিয়মিত ডিম খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আমাদের শরীর গঠনের জন্য প্রোটিনের অন্যতম উপাদান যে নয়টি এসেন্সিয়াল এমাইনো এসিড দরকার তার সবকটিই থাকে ডিমের সাদা অংশে। সেজন্য
ডিম খেলে সম্পূর্ণ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। বয়সজনিত কারণে অনেক সময় মাংসপেশী শিথিল হয়ে যায়, ডিমের কুসুমে যে এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে তা মাংসপেশীকে সুস্থ রাখে।
ডিম কোলিন ও জিংকের উৎস
আমাদের সার্বিক সুস্থতায় কোলিন গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। দেহে কোলিনের ঘাটতি হলে লিভারের সমস্যা হয়। ডিমে প্রায় ৩০০-৩৫০ গ্রাম কোলিন থাকে। তাই ডিম লিভার, কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেম, স্নায়ু এবং মস্তিষ্ক ভালো রাখে। আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ডিমের ভ‚মিকা রয়েছে। ডিমে থাকা জিংক আমাদের দেহে ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। সর্দি, কাশি, জ্বরসহ বিভিন্ন রকমের রোধ প্রতিরোধ করতে ডিম খাওয়া দরকার।
চোখের যত্নে ডিম
চোখের স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান হলো ডিম। ডিমের কুশুমে থাকে ভিটামিন এ, লিউটিইন, জিয়াজ্যানথিন এবং জিংক যেগুলো চোখের সুরক্ষায় খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। বিশেষকরে ভিটামিন এ হলো কর্ণিয়ার জন্য সেফগার্ড। কাজেই চোখের যতেœ দৈনিক ২টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। ডিমে বিদ্যমাণ এন্টিঅক্সিডেন্ট লিউটিইন ও জিয়াজ্যানথিন চোখের রোগ যেমন ক্যাটার্যাক্ট ও ম্যাকুলার ডিজেনারেশন প্রতিরোধ করে। তাছাড়া সিদ্ধ ডিম খাওয়া চোখের ছানি হওয়ার ঝুঁকি কমায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (২০১৫) তথ্যমতে শতকরা ৮০ ভাগ অন্ধত্ব উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসা ও সার্জারির মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ অন্ধত্বই চোখের ছানির জন্য ঘটে থাকে। আর এর অপারেশন খরচও ততটা বেশি না। মানুষ অসচেতনতা এবং দারিদ্রের কারণে ছানি বয়ে বেড়ায় এবং এক পর্যায়ে এসে অবধারিতভাবে অন্ধত্ব বরণ করে।
চুল ও দাঁতের জন্য ডিম
চুল ও নখের মান উন্নত রাখতে নিয়মিত ডিম খান। কারণ ডিমের মধ্যে থাকা উচ্চ মাত্রায় সালফার চুল ও নখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। প্রতিদিন অত্যন্ত একটি ডিম খেলেই ৯ ধরণের রোগ থেকে মিলবে মুক্তি। শুধু তাই নয় ডিমের নানা পুষ্টি গুণাগুন শরীরকে রাখে সতেজ ও শক্তিতে ভরপুর। ডিমে থাকা ফসফরাস হাড় ও দাঁত মজবুত রাখে।
ডিম কোলেষ্টেরল বাড়ায় না
একটি গবেষণায় দেখা গেছে ডিম খেলে দেহে কোলেস্টেরল বাড়ে না। দিনে একটা ডিম খেলে মানুষের দেহে লিপিড প্রোফাইলে কোনো প্রভাব পড়েনা। সিদ্ধ ডিমের কুসুম ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমিয়ে উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। সিদ্ধ ডিমের সাদা অংশ কোলেস্টরল কমাতে সাহায্য করে। ডিমে কোলিন থাকায় স্নায়ু ও হৃদযন্ত্র সচল রাখতে সাহায্য করে। এটা মস্তিষ্কের
মেমব্রেন ও পেশি সুগঠিত রাখতে সাহায্য করে, যা মস্তিষ্কের ঝিল্লি গঠন করতে সহায়তা করে এবং এটা স্নায়ু থেকে পেশিতে সংবেদন পৌঁছাতে সহায়তা করে।
অতিমারী ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ডিম
সারা বিশ্বে ডিমের উৎপাদন বছরে প্রায় ৮০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। জাপানিরা প্রত্যেকে গড়ে প্রতি বছর ৩২০টি ডিম খেয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই সংখ্যা সে তুলনায় অনেক কম, বর্তমানে প্রায় ১৩৬টি (ডিএলএস, ২০২১-২২)। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে অন্য যেকোনো প্রাণিজ আমিষের চেয়ে ডিমের উপস্থিতি প্রতি ঘরে ঘরে। দামে কম, বেশি পুষ্টিকর হওয়ায় কোভিড-১৯ এর মতো মহামারির সময়ে প্রোটিন বুস্ট পাওয়ার প্রধান উপায়ই হচ্ছে ডিম খাওয়া। এছাড়া, ডিমের হাই কোয়ালিটি প্রোটিন বøাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে।
ডিমনেশিয়া ও আলঝেইমার্স
ডিমনেশিয়ার প্রাথমিক বিস্তার খুবই ধীরে হয়, এমনকি মাস কিংবা বছর ধরেও হতে পারে। ভুলে যাওয়ার কারণে রোগী হতাশ, নিদ্রাহীনতা ও অন্যান্য সমস্যায় ভোগে এবং আস্তে আস্তে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সাড়া বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মানুষ ডিমনেশিয়ায় ভুগছে। এজন্য প্রতিবছর ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ডিমনেশিয়া সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। ডিমনেশিয়া খুবই সাধারণ একটি রোগ। ইউকেতে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ জনের ডিমনেশিয়া দেখা দেয়। সেখানে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মদ্যে ডিমনেশিয়ার হার বেশি। ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডিমনেশিয়ার ঝুঁকি বেশি, তবে এটি তরুণদেরও প্রভাবিত করতে পারে। কিছু মানুষের ডিমনেশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যেমন যাদের স্ট্রোক হয়েছে বা যাদের রয়েছে: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল, বিষন্নতা ইত্যাদি। নিয়মিত মুরগির মাংস ও ডিম খাওয়ার ফলে ডিমনেশিয়া বন্ধ করা যেতে পারে ও আলঝেইমার্স রোগ হতেও মুক্তি পাওয়া যায়।
ডিম বিষয়ে উন্নত দেশ ও জার্নালের তথ্য
চীনে প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রতিদিন একটি করে ডিম খেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমতে পারে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের তথ্য মতে, দৈনিক একটি ডিম হার্টের ক্ষতি নয় বরং উপকার করে। প্রক্রিয়াজাত মাংসের চেয়ে ডিম খাওয়া ভালো। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সপ্তাহে ৫-৬ টি ডিম খেলেও উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কোলেস্টেরলের কোনো ঝুঁকি থাকে না। মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন হচ্ছে IFNalpha2a এবং macrophage-CSF যার উপরে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রথম প্রোটিনটি ক্যান্সার প্রতিরোধী এবং দ্বিতীয়টি ক্ষতিগ্রস্থ টিস্যুকে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই ওষুধের একটি ডোজ তৈরি করতে মাত্র তিনটি ডিমই যথেষ্ট (এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটেন, ২০১৯)।
উপসংহার
ডিম থেকে শারীরিক উপকার পেতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে। তবে একসময় যে বলা হতো বেশি ডিম খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর, বিজ্ঞানীরা এখন সে মতবাদ পাল্টে ফেলেছেন। স্বাস্থ্যবান মেধাবী জনগোষ্ঠী গড়তে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ডিম খাওয়া বাড়াতে হবে। ক্রমাগত হারে ডিম খাওয়ার পরিমাণ বছর বছর বাড়লেও তা সন্তোষজনক নয়। আগামী ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যবান মেধাবী জনগোষ্ঠী গড়তে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ডিম খাওয়ার পরিমাণ দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি করতে হবে। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে ২য় শুক্রবার বিশ্ব ডিম দিবসে ডিম খাওয়ার সচেতনতা বৃদ্ধিতে সারা বিশ^ ব্যাপী ডিম বিষয়ক নানা কার্যক্রম হয়ে থাকে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও দপ্তর প্রধান (রু. দা.)
পোলট্রি রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট
সাভার, ঢাকা এবং প্রকল্প পরিচালক, পোলট্রি গবেষনা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প।
কর্পোরেট অফিস:
বাড়ী নং ২৫, রোড নং ০২, সেক্টর-১১, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০
Email:
[email protected]
Phone:
01716-607530
01911-437848
গাজীপুর অফিস:
এ/২২২, দিঘীরচালা, চান্দনা-১৭০২, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন