মানুষ শত শত বছর ধরে দই খাচ্ছে। দই শুধু মজাদার খাবারই নয়, এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকরও বটে। দইয়ের অনেক উপকারিতার কারণে এটি সারা বিশ্বে একটি প্রিয় খাদ্য উপাদান। বলা হয়ে থাকে দুধের চেয়ে দই বেশি উপকারী। দই স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য উভয়ের জন্যই খুব ভালো। নিয়মিত দই খাওয়া আপনার স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিককে বাড়িয়ে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দই হৃদরোগ এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি হ্রাস করার পাশাপাশি ওজন কমাতে সহায়তা করে। আমাদের দেশ ছাড়াও বিদেশের লোকেরা দিনের বেলায় খাবারে এটি গ্রহণ করে। চিকিৎসক এবং সমস্ত ডায়েটিশিয়ানরা দুপুরের খাবারে এক বাটি দই খাওয়ার পরামর্শ দেন।
দই কী:
দধি বা দই হল এক ধরনের দুগ্ধজাত খাদ্য যা দুধের ব্যাক্টেরিয়া গাঁজন হতে প্রস্তুত করা হয়। ল্যাক্টোজের গাঁজনের মাধ্যমে ল্যাক্টিক এসিড তৈরি করা হয়, যা দুধের প্রোটিনের ওপর কাজ করে দইয়ের স্বাদ ও এর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গন্ধ প্রদান করে। মানুষ ৪৫০০ বছর ধরে দই প্রস্তুত করছে এবং তা খেয়ে আসছে। সারা পৃথিবীতেই এটি পরিচিত।
পরীক্ষাগারে দই নিয়ে এক বছর ঘাম ঝরানোর পর গ্রিগোরভ আবিষ্কার করেন, গাঁজন প্রক্রিয়ায় দুধ থেকে দই হতে ঠিক কোন ব্যাকটেরিয়া দায়ী। গ্রিগোরভ এবং বুলগেরিয়ানদের দই প্রীতির সম্মানে সেই জীবাণুটির নাম রাখা হয় “ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকাস”। এছাড়াও দই এ “স্ট্রেপ্টোকক্কাস থারমোফিলাস” নামক ব্যাক্টেরিয়াসহ অনেক ধরনের ঊপকারী ব্যাক্টেরিয়া থাকে।
কেন দই খাবেন:
সুস্থ থাকার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়মিত পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। পাশাপাশি অবশ্যই এমন খাবার খেতে হবে যেগুলো শরীরের জন্য উপকারী। এমনই একটি উপকারী খাবার হলো দই। সরাসরি দুধ খেতে যাদের সমস্যা হয়, তারা নির্দ্বিধায় এটি খেতে পারেন। পুষ্টিবিদদের মতে, দুধের সমান পুষ্টি পুরোটাই মেলে দইয়ে। তাই পূরণ হয় ভিটামিন, মিনারেল, আমিষের চাহিদা। তাজা দইয়ে অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী। দুধে চর্বি বেশি থাকে, যার কারণে এক সময় শরীরে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু দইয়ে ফ্যাট অনেক কম, কম ফ্যাট দুধ দিয়ে তৈরি দইয়ে ফ্যাট একেবারেই নেই। সুতরাং সুস্থ জীবনের জন্য প্রত্যাহিক খাদ্য তালিকায় দইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
দইয়ের পুষ্টিগুণ:
সাধারণত ১০০ গ্রাম দইয়ের পুষ্টিগুণ নিম্ন রূপে হিসেব করা হয়। ক্যালোরি ১০০-১৫০, চর্বি ২ গ্রাম, চিনি ২০ গ্রাম, প্রোটিন ৮-৯ গ্রাম, ভিটামিন ডি ২০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২০গ্রাম এছাড়াও এতে ফসফরাস, আয়রন, ল্যাকটোজ রয়েছে। দইয়ে আপনার দেহের প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পুষ্টি উপাদান থাকে। এটি প্রচুর ক্যালসিয়াম, স্বাস্থ্যকর দাঁত এবং হাড়ের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ ধারণের জন্য পরিচিত। কেবল এক কাপ দই আপনার প্রতিদিনের ক্যালসিয়ামের ৪৯% সরবরাহ করে। এর ভিটামিন বি, বিশেষত ভিটামিন বি১২ এবং রাইবোফ্লাভিনেও বেশি, উভয়ই হৃদরোগ এবং কিছু স্নায়ুবিক ত্রুটি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। এক কাপ দই আপনার প্রতিদিনের প্রয়োজনের ফসফরাসের ৩৮%, ম্যাগনেসিয়ামের ১২% এবং পটাসিয়ামের ১৮% সরবরাহ করে। এই খনিজগুলো বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়ার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়, যেমন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, বিপাক এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রণ। একটি পুষ্টি ঊপাদান যা দইয়ে প্রাকৃতিকভাবে থাকে না তা হ’ল ভিটামিন ডি, তবে এটি সাধারণত ভিটামিন ডি আর মাত্রাকে শক্তিশালী করে। ভিটামিন ডি হাড় এবং ইমিউন সিস্টেমের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং হৃদরোগ এবং হতাশাসহ কিছু রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে
দইয়ের উপকারিতা:
খাদ্যতালিকায় দুগ্ধজাত এ উপাদানটি নিয়মিত রাখলে আপনি বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত সুবিধা পাবেন। চলুন তাহলে জেনে নেই, কেন আপনার নিত্য দিনের রুটিনে দই রাখা উচিত।
১. পুষ্টিকর উপাদানের চাহিদা মেটায় নিয়মিত দই খাওয়া শুরু করলে শরীরে পটাশিয়াম, ফসফরাস এবং আয়োডিনের ঘাটতি দূর হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে ভিটামিন বি৫ এবং বি১২-এর মাত্রাও বাড়তে থাকে। আর এই সবকটি উপাদানই যে নানাভাবে শরীরের উপকারে লেগে থাকে, তা সর্বজন স্বীকৃত। এই যেমন ধরুন ভিটামিন বি১২ লোহিত রক্ত কণিকার উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নার্ভাস সিস্টেমের কর্মক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে থাকে।
২. হার্টের জন্য উপকারী আজকাল হার্ট সংক্রান্ত সমস্যা বয়সের কারণে হয় না, বরং ডায়েটের (খাদ্যাভ্যাস) কারণে অল্প বয়সেই এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটি এড়াতে আপনার দই খাওয়া উচিত, প্রতিদিন দই খেলে আপনার হার্টের যতœ নেয়া হয়। রক্তে খারাপ কোলেস্টরল বা এল ডি এল-এর মাত্রা কমানোর পাশাপাশি রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখে দই। তাই তো নিয়মিত এই দুগ্ধজাত খাবারটি খেলে হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে। তাই আপনার পরিবারে যদি কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ইতিহাস থাকে তাহলে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় দইকে সঙ্গে রাখুন।
৩। স্ট্রেস এবং অ্যাংজাইটির প্রকোপ কমে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দই খাওয়ার পর আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে এমন কিছু পরিবর্তন হয় যে মানসিক চাপ এবং অ্যাংজাইটি কমতে শুরু করে। প্রসঙ্গত, বর্তমান সময়ে যে সব মরণ রোগের কারণে সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, তার প্রায় সবকটির সঙ্গেই স্ট্রেসের যোগ রয়েছে। তাই তো নিয়মিত দই খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা যে বেড়েছে, সে বিষযে কোনও সন্দেহ নেই।
৪। ক্যান্সারের মতো রোগকে প্রতিরোধ করে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দইয়ে উপস্থিত ল্যাকটোব্যাসিলাস এবং স্ট্রেপটোকক্কাস থারমোফিলাস নামক দুটি ব্যাকটেরিয়া শরীরের ভেতরে ক্যান্সার সেলের জন্ম কে আটকে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্যান্সারের মতো মারণ রোগ ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না।
৫। হজম শক্তি বৃদ্ধি করে স¤প্রতি বেশি কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দইয়ে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা পাকস্থলিতে হজমে সহায়ক ভাল ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভ‚মিকা নেয়। সেই কারণেই তো বদ-হজম এবং গ্যাস-অম্বলের সমস্যা কমাতে দই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। প্রসঙ্গত, পৃথক একটি গবেষণায় দেখা গেছে পেপটিক আলসার হওয়ার পিছনে দায়ি এইচ পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফলতেও দইয়ের কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে। সেই কারণেই তো পেপটিক আলসারের চিকিৎসায় দইয়ের অন্তর্ভুক্তির পিছনে সচেতন করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।
৬। দুধের বিকল্প হিসেবে এমন অনেকই আছেন যারা একেবারে দুধ খেতে পারেন না। কারণ গন্ধ লাগে, তো কারও বমি পায়। এই ধরনের সমস্যাকে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বলা হয়। প্রসঙ্গত, দুধ থেকে দই হওয়ার সময় ল্যাকটোজ, ল্যাকটিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ফলে দই খেলে না গা গোলায়, না বমি পায়। সুতরাং যারা দুধ খেতে বা হজম করতে পারেন না অনায়েসে দই খেতে পারেন।
৭।ওজন নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকর ভ‚মিকা রাখে অতিরিক্তি ওজনের কারণে কি চিন্তায় রয়েছেন? তাহলে নিয়মিত এক বাটি করে দই খাওয়া শুরু করুন। দেখবেন দারুন উপকার মিলবে। বিশেষত ভুঁড়ি কমাতে দইয়ের কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে। প্রসঙ্গত, ইউনিভার্সিটি অব টেনেসির গবেষকদের করা একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, নিয়মিত দই খাওয়া শুরু করলে হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটে। সেই সঙ্গে কর্টিজল হরমোনের ক্ষরণও কমে যায়। ফলে ওজন হ্রাসের সম্ভাবনা প্রায় ২২ শতাংশ বেড়ে যায়।
৮। হাড় এবং দাঁতের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে দুধের মতো দইয়েও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফসফরাস এবং ক্যালসিয়াম। এই দুটি উপাদান দাঁত এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। তাই বুড়ো বয়সে গিয়ে যদি অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মতো রোগ আক্রান্ত হতে না চান, তাহলে এখন থেকেই নিয়মিত দই খাওয়া শুরু করুন। এমনটা করলে দেখবেন উপকার মিলবেই মিলবে।
৯। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটে দইয়ে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরের ভিতরে থাকা জীবাণু এবং চারপাশের ছোট ছোট জীবাণুর সাথে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায়। দই খেলে শরীরে চাঞ্চল্য আসে এবং অনেক রোগ দূরে থাকে। দইয়ে উপস্থিত উপকারি ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করার পর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এতটাই শক্তিশালী করে দেয় যে সংক্রমণ থেকে ভাইরাল ফিবার, কোনও কিছুই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। ফলে সুস্থ জীবনের পথ প্রশস্ত হয়। দই খেলে হজম ঠিকমতো হয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস, এসিডিটির মতো সমস্যা দূর হয়। আর এই করোনা মহামারীকালীন সময় আমাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে নিজেকে নিরাপদ রাখা, তাই আপনার অবশ্যই উচিত প্রতিদিনের ডায়েটে এক বাটি দই যোগ করা এবং সেটাকে একটা অভ্যাসে পরিবত করা।
১০। ভেজাইনাল ইনফেকশের মতো রোগ দূরে থাকে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দইয়ে উপস্থিত ল্যাকটো ব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস নামক একটি ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করে এমন খেল দেখায় যে ক্ষতিকর জীবাণুরা সব মারা পরে। ফলে ভেজাইনাল ইনফেকশনের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। এই কারণেই তো নারীদের নিয়মিত দই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।
১১। মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টসের ঘাটতি দূর করে দইয়ে প্রচুর মাত্রায় মজুত রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং জিঙ্কের মতো উপকারি উপাদান। তাই তো নিয়মিত এক বাটি করে দই খাওয়া শুরু করলে শরীরে নানাবিধ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসের ঘাটতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা যায় কমে। ফলে শরীর এতটাই চাঙ্গা হয়ে ওঠে যে ছোট-বড় কোন রোগই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না।
১২। ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দই মুখে উজ্জ্বলতা আনে, ট্যানিং ও মুখের ময়লা দূর করে। এটি ব্রণের দাগও দূর করে। দইয়ে পরিমাণ মতো বেসন এবং অল্প করে লেবুর রস মিশিয়ে যদি মুখে লাগাতে পারেন তাহলে ত্বক নিয়ে আর কোনও চিন্তাই থাকে না। আসলে দইয়ে থাকা জিঙ্ক, ভিটামিন ই এবং ফসফরাস এক্ষেত্রে বিশেষ ভ‚মিকা পলন করে থাকে। প্রসঙ্গত, এই ফেস প্যাকটি সপ্তাহে কম করে ২-৩ বার লাগালে দারুন উপকার মেলে।
শেষ কথা:
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ফাস্ট ফুডে বাজার সয়লাব। আর এ ক্ষতিকর ফাস্ট ফুড খাওয়া সবার কাছে ফ্যাসনে পরিণত হয়েছে। ফলশ্রæতিতে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই আমাদের নিত্য সংগী। বিভিন্ন খাবারের ক্ষতিকর উপাদান থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে আপনার পাকস্থলীকে ঠান্ডা রাখতে দই বেশ উপকারী। নিয়মিত দই খেয়ে ত্বক ও চুলের সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পারেন। দইয়ে থাকা ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি৬ পাকস্থলী সহজে গ্রহণ করে। তাই ভালো হজমের জন্য দই খাওয়ার পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদরা। এতে প্রচুর উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে বলে বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য ও এসিডিটি দূর করে। এতে প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্টও থাকে। তবে দইয়ের মধ্যে মিষ্টি দই অপেক্ষা টক দই-ই কিন্তু বেশী উপকারী। পরিশেষে, সুস্থ্য থাকার সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।
লেখক: ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়