আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। গ্রামটা ছিল সবুজ শ্যামল, পাখি ডাকা, নিরিবিলি পরিবেশ। গাছের ডালে ডালে পাখির কলকাকলিতে সবসময় মাতোয়ারা থাকত। আর পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙতো। বিকেল গরিয়ে যখন সন্ধ্যা আসত তখন আকাশজুড়ে পাখিরা দল বেঁধে উড়ে বেড়াত। সে ছিল এক অপরূপ দৃশ্য।
আহা! কি মধুরই না ছিল সেইসব দিনগুলো। প্রায় বাড়িতেই চড়ুইয়ের পাখির বাসা থাকত, বিশেষ করে দেয়ালের ফাঁকে কিংবা ঘরের কোনায়। এখন এই ইট-পাথরের শহরে সেই রূপ আর নেই। গ্রামে যদিও বা কিছু পাখি দেখতে পাওয়া যায়, ঢাকা শহরে তো এক কাক ছাড়া অন্য কোনো পাখি খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর। এই পরিস্থিতির জন্য জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন অন্যতম কারণ। যার কারণে বিপর্যয় ঘটছে পরিবেশের। হুমকির মুখে আজ জীব বৈচিত্র্য। আর এতে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে চেনা জানা বহু পাখি।
তাইতো, এখন আমরা সহসাই পাখির গান শুনতে পাই না। আর পাখির কলতানে ঘুম ভাঙ্গা, সেটা যেন এ প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠছে রূপকথার গল্প। ঘুঘু পাখির কুহুতান শোনা সে আজ ভাগ্যের বিষয়। কৃষকের নাঙ্গলের পিছনের পোকা মাকড় খাওয়ার জন্য পাখির সে দৃশ্য আজ দেখা যায় না। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য চিরচিনা সুরকার বাবুই পাখির বাসা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বালিহাঁসের মতো সুদর্শন পাখিটিও আর চোখে পড়ে না। নিশাচর বাদুড়, পেঁচা এখন তেমন দেখতে পাওয়া যায় না। নিমিষেই মৃত পশু বা জীব-জানোয়ার খেয়ে সাবাড় করা সে শকুন বিলুপ্ত পথে। আগের মত এখন আর দোয়েল, ময়না, বুলবুলি, চড়াই, শ্যামা, শালিক, কাঠ ঠোকরা, চন্দনা, কালিম, ডানা ঘুরানি, বউ কথা কও এর মত পাখিদের আর সচরাচর দেখা যায় না। নগরায়নের সভ্যতা কেড়ে নিচ্ছে সব। দিনে দিনে গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
পাখিদের বসবাসের পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলছি আমরা সবল হাতের ছোবলে।
ঋতুর রঙ্গমঞ্চে যখন তীব্র শীতের আবির্ভার ঘটে, তখন দূর দেশ থেকে অতিথি পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণের আকুতি নিয়ে হাজির হয় এ দেশে। এই অতিথি পাখি কখনও আশ্রয় নেয় গাঁ-গ্রামের বড়সড় দীঘিতে, কখনও বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড় কিংবা শহরের পূর্বের চিহ্নিত লেকে। তাদের করুণায় থাকে আশ্রয়ের আবদার। কিন্তু দিন দিন প্রাকৃতিক জলাভূমি কমে যাওয়া এবং দূষণের ফলে অতিথি পাখির সংখ্যা এমনিতেই কমে যাচ্ছে। এর ওপর চোরা শিকারিরা জালের ফাঁদ পেতে কিংবা ধানের সঙ্গে এক ধরনের কীটনাশক মিশিয়ে ‘বিষটোপ’ তৈরি করে অবাধে পাখি শিকার করছে। শুধু অতিথি পাখি নয়, বকের মতো দেশীয় প্রজাতির পাখিও শিকার চলছে দেদার।
অথচ পরিবেশ রক্ষায় মানুষের চেয়ে পাখির ভূমিকা কোনো অংশেই কম না। পাখি তার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে খাওয়া ফলের বীজ আপনা থেকেই একসময় পড়ে মাটিতে। আমাদের উর্বর মাটির জাদুর স্পর্শে তা থেকে জন্ম নেয় একেকটি বৃক্ষ তারাও আবার পূর্ণতা লাভ করে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার সংকল্পে। এভাবেই বনায়ন তৈরিতে প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে পাখিরা। কালের আবর্তে বাংলার প্রকৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বন্ধু প্রতিম এ পাখিরা। হাওড়-বাঁওড়, বিল শুকিয়ে যাচ্ছে, এছাড়াও শুকিয়ে যাচ্ছে আমাদের জলাভূমি, নদী-খালগুলো, ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুর। এসব জলাভূমি, হাওর-বাঁওড় থেকে খাবার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে পাখিগুলো।
এছাড়াও বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন কারণে অকারনে। এসব গাছগুলো পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে থাকে। পাখির আবাসস্থল নির্বিচারে ধ্বংস ও বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক দেয়ার প্রভাবে এসব পাখি আজ বিলুপ্তপ্রায়। আবার বিষযুক্ত খাদ্য খেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে পাখিরা। বংশ বৃদ্ধি তো দূরের কথা টিকে থাকাই পাখিদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার জলাভূমি বাণিজ্যিক ব্যবহারের কারণে পাখির বসবাসের পরিবেশ নেই। এ ছাড়া ফল সুরক্ষার নামে কারেন্ট জালের ব্যবহার বেড়েছে। এতে করে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ওই জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। আর নির্বিচারে পাখি শিকার তো আজও চলছে। এসব কারণেই পাখিরা দিন দিন সংখ্যায় কমে যাচ্ছে।
বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানতে পারলাম, বাংলাদেশে ৬৫০ প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে ৩০টি বর্তমানে বিলুপ্ত, অতীতে ছিল। ৬২০টি প্রজাতির মধ্যে ১৪৩টি প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে কালেভদ্রে দেখা যায়। বাকি ৪৭৭ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে নিয়মিত দেখা যায়। এই ৪৭৭ প্রজাতির মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশের ‘আবাসিক’ পাখি। যেগুলো স্থায়ীভাবে এদেশে বাস করে। বাকি ১৭৫টি বাংলাদেশের ‘পরিযায়ী’ পাখি যেগুলো খন্ডকালের জন্য নিয়মিতভাবে এদেশে থাকে। এই ১৭৬ প্রজাতির মধ্যে ১৬০টি শীতে এবং ৬টি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে থাকে, বাকি ১০টি বসন্তে এদেশে থাকে, যাদেরকে ‘পান্থ পরিযায়ী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাখি শিকার করা ফৌজদারি অপরাধ। এ সম্পর্কিত আইনে বলা হয়েছে যে, সর্বোচ্চ সাজা ১ বছরের কারাদন্ড এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা। একই কাজের পুনরাবৃত্তি হলে ২ বছরের কারাদন্ড, ২ লাখ টাকা এবং উভয় দন্ড প্রযোজ্য। আশার কথা হল, বিগত ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের জীববৈচিত্র্য পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে এয়ারগান ব্যবহার ও বহন নিষিদ্ধ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, নিশ্চয়ই তা পাখি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। একটু সচেতনতাই পারে আমাদের দেশটাকে পাখির কলকাকলিতে মুখরিত করে রাখতে।
এখন প্রশ্ন হল, দেশে আইন আছে ; তবু কেন পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবে? আমরা কিছুই করব না। আমাদের করণীয় কিছুই নেই। উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। অনেকভাবে দেশের পাখিগুলোকে বাঁচানো যায়। যার মধ্যে অন্যতম হলো খাচায় ব্রিড করে বনে ছেড়ে দেওয়া। এ পদক্ষেপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডিয়ান ফিঞ্চ পাখি বিলুপ্ত হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তখন বন্য থেকে গোল্ডিয়ান এনে ব্রিডারদের দেওয়া হয়। তারা অসংখ্য গোল্ডিয়ান উৎপাদন করে। অন্যদিকে কিছু পাখি বনে ছেড়ে দেয়। ফলে বিলুপ্তির হাত থেকে পাখিটি রক্ষা পায়। এছাড়া পাখি রিচার্স কেন্দ্র করা যায়। তারাও পারে বিলুপ্তপ্রায় পাখির প্রজনন ঘটানোর কাজ করতে। এটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। গাছের পাখিদের জন্য কিছু ফলও রাখা যায়।
আসলে আমাদের দেশে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অভায়ারণ্য আছে বটে। তবে সেগুলোর সঠিক দেখাশোনা নেই। এ অবস্থায় অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা দরকার। দরকার পাখির জন্য বাসা গাছে বেধে দেয়া। গাছ লাগানোর কথা যুগ যুগ ধরে বলা হচ্ছে। হাজারো উদ্যোগ। কিন্তু বনভূমির সংখ্যা বাড়ছে না। গাছের সংখ্যা দিন দিন কমেই যাচ্ছে। অন্ধ আবেগ নয়। বাস্তবতা মাথায় রেখে বনের পাখি বাঁচাতে হবে। যুগোপযোগী আধুনিক বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবী।
লেখক: উপ পরিচালক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়