বর্তমানকালে জেনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বদৌলতে মুরগীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উন্নত জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহের সুরক্ষাকে অবজ্ঞা করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে মেটাবলিক বিশৃংখলা (Disorder) দেখা দেয়। কিডনি এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যার একাধিক মেটাবলিক ও নিঃসরণ ধর্মী কাজ সম্পাদন করে। যেমন-শরীরে বিভিন্ন তরল পদার্থের রাসায়নিক সংযুক্তি বজায় রাখা, মেটাবলিক বর্জ্য ও বিষাক্ত দ্রব্য দূরীভূত করা, রক্তচাপ ও আয়তন নিয়ন্ত্রণ করা, শরীরের রস (Fluid) ও ইলেকট্রোলাইট এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
গাউট হল একটি মেটাবলিক রোগ যা কিডনীর সাথে সম্পৃক্ত। এ রোগে সাদা চকের মত পদার্থ (ইউরিক এসিড) বা স্ফীত ইউরেটস জমা হয় যা মূলত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নরম কলা যেমন- কিডনী, নরম কলা, পেরিটোনিয়াম এবং জয়েন্ট এ দেখা যায়। ইউরিক এসিড মূলত লিভার ও কিডনির নি:সরণ এর মাধ্যমে তৈরী হয়। ইউরিক এসিড নিজে কোন বিষাক্ত বা ক্ষতিকর নয় কিন্তÍু এর ফলে ক্রিস্টালস গঠিত হয় যা মারাত্নকভাবে শরীরের কোষ ও কলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইউরিক এসিড এর ক্রিস্টাল গঠনের ফলে কিডনী ঠিকমত কাজ করতে পারে না ও প্রোটিন জাতীয় খাদ্য বিপাকে সমস্যা হয় ফলে বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন সঠিকভাবে হয় না। এ রোগটি হার্বাড এবং কব জাতের ব্রয়লারে বেশি পরিলক্ষিত হয় তবে আরবর একরসে কম দেখা যায়।
এ রোগের অন্য নাম সমূহ হল তীব্র টক্সিন নেফ্রাইটিস, রেনাল গাউট, কিডনি স্টোনস, নেফ্রোসিস, রেনাল গাউট, আর্টিকুলার গাউট, নিউট্রিশনাল গাউট (Nutritional gout), কিডনী স্টোনস (Kidney stones).
কারণ সমূহ: এভিয়ান গাউট এর সঠিক কারণ সুস্পষ্ট নয় কিন্তু নিম্নের বিভিন্ন ফ্যাক্টর সমূহ শত্তিশালী কারণ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
সংক্রামক রোগ: যে সমস্ত রোগ সমূহ গাউট এর ঝৃুঁকি বাড়িয়ে দেয় তার মধ্যে এভিয়ান নেফ্রাইটিস, ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস ভাইরাসের নেফ্রোটিক স্ট্রেইন ও বেবি চিক নেফ্রোপ্যাথি অন্যতম।
১) ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস ভাইরাস: যা খুবই সংক্রামক যার সাথে সাধারণত শ্বাসতন্ত্র সম্পৃক্ত থাকে কিন্তু এটি প্রজননতন্ত্র ও মুত্রতন্ত্রকেও আক্রমণ করে। এ ভাইরাসের একটি স্ট্রেইন যা নেফ্রো প্যাফোজেনিক (nephron pathogenic) স্ট্রেইন নামে পরিচিত যা কিডনীর মারাত্নক ক্ষতি করে। সাব ক্লিনিক্যাল অবস্থায় এ রোগগুলোর সাথে অন্যান্য ফ্যাক্টর যেমন উচ্চ মাত্রার প্রোটিন বা ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি গাউটের সম্ভবনা বাড়িয়ে দেয়।
২) এভিয়ান নেফ্রাইটিস ভাইরাস: যা এক ধরনের enterovirus কিডনীকে আক্রান্ত করে। সেরোলজিক্যাল সার্ভেতে দেখা গেছে যে এশিয়া ও ইউরোপে মুরগি ও টারকির সিরামে এ ভাইরাসের এন্টিবডি পাওয়া গেছে।
পুষ্টিগত কারণ: পুষ্টিগত বা মেটাবলিক ফ্যাক্টর যা কিডনিকে আক্রান্ত করে তা হল: ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ভারসাম্যহীনতা: লেয়ার রেশনে যদি ফসফরাসের সাথে সঙ্গতি রেখে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম সরবরাহ করা হয় অথবা ফসফরাসের পরিমাণ কম থাকে তবে গাউট হতে পারে। এক্ষেত্রে ফসফরাসের ঘাটতি থাকলে মুত্র ক্ষারীয় হয় যার ফলশ্রুতিতে গাউট সমস্যা দেখা দেয়।
ভিটামিন এ এর ঘাটতি: দীর্ঘদিন ধরে ভিটামিন এ এর ঘাটতি থাকলে গাউট হতে পারে। এটি ইউরেটার এর বাইরের স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ফসফরাসের ঘাটতি: ফসফরাস ক্যালসিয়াম জনিত ক্ষতি থেকে কিডনিকে আংশিক সুরক্ষা দেয়। ফসফরাস ইফরিন এসিডিফায়ার হিসাবে কাজ করে এবং কিডনীতে পাথর জমা রোধ করে। তাই যদি গ্রোয়ার খাদ্যে নিম্ন মাত্রার ফসফরাস থাকলে গাউট এর ঝুকি বেড়ে যায়।
অধিক ভিটামিন ডি ৩: খাদ্যে যদি অধিক পরিমাণে ভিটামিন ডি৩ (ঐুঢ়বৎারঃধসরহড়ংরং) থাকে তবে তা ক্যালসিয়াম শোষনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ফলে গাউট সৃষ্টি হয়।
অতিরিক্ত সোডিয়াম: লেয়ার রেশনে অতিরিক্ত সোডিয়াম সরবরাহ (০.৪% পানিতে এবং ০.৮% খাদ্যে) করলে ইউরেট নিঃসরণ বেড়ে যায় কারণ ইউরিক এসিড এর কলয়েড ঋনাত্নক চার্জযুক্ত হওয়ায় এটি সোডিয়াম ক্যটায়নকে আকৃষ্ট করে। এটা মূলত খাদ্যে ফিসমিল (এমনকি লবণ স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলেও ) ব্যবহার করলে হয়ে থাকে কারণ ফিসমিল লবণ সমৃদ্ধ।
অতিরিক্ত প্রোটিন: খাদ্যে ৩০% এর বেশি প্রোটিন ব্যবহার করলে অতিরিক্ত মাত্রায় ইউরিক এসিড উৎপাদন হয় যার ফলে কিডনীর উপর নিস্ক্রমণজনিত (Excretory)চাপ বেশি পড়ে। এর সাথে সালফেটের উপস্থিতি থাকায় ক্যালসিয়াম Resorption হ্রাস পায় যার কারণে মূত্রের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম নিঃসরণ বেড়ে গিয়ে গাউটকে ত্বরান্বিত করে।
পানি বঞ্চিত (Water deprivation) হওয়া: পানি কম খেলে বা কম গ্রহণ করলে ইউরিক এসিডের ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং রক্তে অন্যান্য খনিজের পরিমাণ বেড়ে যায় যা শেষ পর্যন্ত রক্তে আসে। গরমকালে পানির অভাব আরো বিপদজনক। এটা মূলত বাচ্চা পরিবহন বা নিপল এ ব্লক হলে, পানির পাত্রের অপর্যাপ্ততা, পানির পাত্রের অধিক উচ্চতা, অধিক ঘনত্ব, ভ্যাকসিনের আগে অধিক সময় ধরে পানি বঞ্চিত রাখা ইত্যাদির কারণে হতে পারে। খর পানিতে অতিরিক্ত ধাতব লবণের উপস্থিতি কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করে। নতুন ফুটানো বাচ্চার ব্রুডিংয়ে অতিরিক্ত তাপ প্রয়োগ বা হ্যাচারিতে বেশী সময় অবস্থান করার ফলে পানি স্বল্পতা হয়ে অনেক ক্ষেত্রে অবস্থা হতে পারে।
বিষাক্তজনিত (Toxic) কারন:
১) মাইকোটক্সিন: মাইকোটক্সিন এর কারণে সবচেয়ে বেশি কিডনী ক্ষতি হয়ে থাকে এবং এর মধ্যে অকরাটক্সিন এবং ওওস্পোরিন বেশি দায়ী। অকরাটক্সিনের সাথে আফলাটক্সিনের সমন্বয় আরো বেশি বিপদজনক। এ সমস্ত ক্ষেত্রে কিডনী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ইউরিক এসিড এর নিঃসরণ কমে যায় ফলে শরীরে ইউরিক এসিড জমতে থাকে।
২) এন্টিবায়োটিক: এন্টিবায়োটিক যেমন জেন্টামাইসিন, সালফোনামাইড এবং নাইট্রোফিউরানস ব্যবহারে কিডনী ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশেষ করে বাচ্চা মুরগিতে। এ সমস্ত ড্রাগস কিডনী দিয়ে নিঃসৃত হওয়ার সময় কিডনীর পি এইচ ও রেনাল মেটাবলিজমে ভারসাম্যহীন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
৩) জীবাণুনাশক (Disinfectant) যেমন- ফেনল এবং ক্রেসল নির্বিচারে ব্যবহার করলে রেসিডিউয়াল টক্সিসিটি (Residual toxicity) হওয়ার সুযোগ থাকে।
৪) কপার সালফেট : পানিতে যদি কপার সালফেট বা তুঁতে ব্যবহার করা হয়, তবে এর কটু স্বাদের জন্য মুরগী অনেক ক্ষেত্রে পানি কম পান করে ফলে এ সমস্যা হতে পারে।
লক্ষণ সমূহ: হঠাৎ মৃত্যু। পায়ুপথের চারপাশে প্রচুর ইউরেটস মিশ্রিত থাকে যা দেখতে সাদা চুনের মত মনে হয়। দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার ক্ষেত্রে শ্বাসনালী, মাথার ঝুটি, কানের লতি ইত্যাদিতে ও ইউরেটস দেখা যায়। ভিসেরাল গাউটের সাথে যদি আর্টিকুলার গাউট থাকে তবে সে ক্ষেত্রে পায়ের জয়েন্টের ভিতর সাদা তরল (ইউরেটস) জমা থাকে এবং পায়ের তলার ও উপরে ইউরেটস জমা হয়ে শক্ত গুটির (Nodules) মত তৈরি হয়। ঝিমানো, পানি স্বল্পতা এবং কিছু ক্ষেত্রে সবুজাভ পাতলা পায়খানা হয়। আক্রান্ত মুরগির শারীরিক দূর্বলতা দেখা যায়, উসখো খুসকো পালক ও ভেজা পায়ু পথ দেখা যায়। পায়ু পথের চারপাশে প্রচুর ইউরেটস মিশ্রিত বিষ্ঠা লেগে থাকে যা দেখতে সাদা চকের গুড়ার মত।
পোস্টমর্টেম তথ্যাদি: হ্নদপিন্ড, কলিজা,বৃক্ক এবং ফুসফুস এ
চকের মত সাদা বস্তু (white chalky deposits) দেখা যায়। বৃক্কে ফোটা ফোটা রক্তক্ষরণ (Pin point) দেখা যায়।
গাউট এর প্রকারভেদ: ইউরিক এসিড নিজে কোন বিষাক্ত বা ক্ষতিকর বস্তু নয় কিন্তু তার ফলে যে ক্রিস্টালস গঠন করে তা মারাত্নকভাবে শরীরের কোষ ও কলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এভিয়ান গাউট প্রধানত দুই ধরনের-
ক) ভিসেরাল গাউট : অন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গের বাইরের আবরণ ও হ্নদপিন্ড থলিতে সাদা চকের মত পদার্থ হয়ে ভিসেরাল গাউট তৈরী হয়।
খ) আর্টিকুলার গাউট: ইউরিক এসিড ক্রিস্টালস যখন জয়েন্ট, পা ও পায়ের পাতাতে জমা হয় তখন আর্টিকুলার গাউট (Articular gout) সৃষ্টি হয়, যা দীর্ঘস্থায়ী হয় যার ফলে জয়েন্ট ফুলে যায়, শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না ফলে মুরগী খোঁড়াতে থাকে।
ভিসেরাল গাউট ও আর্টিকুলার গাউটের মধ্যে পার্থক্য:
পার্থক্যসূচক পয়েন্ট | ভিসেরাল গাউট | আর্টিকুলার গাউট |
রোগের ধরণ | এটি মূলত তীব্র (Acute) প্রকৃতির তবে দীর্ঘমেয়াদি ও (Chronic) হতে পারে। | এটি সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি রোগ |
প্রার্দুভাব | সচরাচর দেখা যায় | দুর্লভ বা কদাচিৎ হয়ে থাকে তবে ভিসেরাল গাউটের সাথে দেখা দিতে পারে। |
বয়স | ব্রয়লার ও ১৪ সপ্তাহের অধিক পুলেটে বেশি হয়। ব্রয়লারে ৩ থেকে ২০ দিন বয়সে বেশি হয়। | ৪-৫ মাস বয়সে এবং তার উপরের মুরগিতে বেশি হয়। |
সেক্স | পুরুষ ও মহিলা উভয়েই সংবেদনশীল। | প্রধানত পুরষ তবে উভয় লিঙ্গে হতে পারে। |
কারণ | সংক্রামক, পুষ্টিজনিত ও টক্সিন ধরনের জেনেটিক | খাদ্যে উ”চ প্রোটিন এর কারণে হয় |
প্রধান লক্ষণ:
কিডনী: কিডনীতে সাদা চকের ন্যায় ক্রিস্টাল দেখা যায় কিডনী স্বাভাবিক থাকে। যদি পানি শূন্যতায় ভোগে তবে সাদা ইউরেট জমতে পারে।
জয়েন্ট: জয়েন্ট এর চারপাশের নরম কলা সম্পৃক্ত থাকে বা থাকতে পারে। তীব্র ক্ষেত্রে মাংস পেশীর আবরণী, টেন্ডন এর সাইনোভিয়াল শিথ এবং জয়েন্ট সম্পৃক্ত থাকে। জয়েন্ট এর চারপাশের নরম কলা সম্পৃক্ত থাকে মূলত পায়ের পাতা। এছাড়া পা, ডানা, স্পাইন এবং ঠোঁট এর জয়েন্ট ও হতে পারে।
নরম কলা ভিসেরাল অঙ্গ যেমন- লিভার, প্লীহা, হ্নদপিন্ডের মধ্য প্রাচীর (Myocardium) এবং সেরোসাল। আবরণ যেমন- ফুসফুসের আবরণ (Pleura), হ্নদপিন্ডের বাইরের আবরণ(Pericardium), বায়ু কোষ (Air sacs), মেসেন্টারী ঝিল্লীতে হয়ে থাকে। স্নৈহিক ঝিল্লী (Synovium) ব্যতীত অন্যান্য নরম কলাতে পরিলক্ষিত হয় না। যদিও উপরের ও নিচের ঝুটি (Comb) এবং ট্রাকিয়াতে পরিলক্ষিত হয়।
আণুক্ষনিক: (Microscopic) সাইনুভিয়াম ও অন্যান্য কলাতে কোন প্রদাহজনিত লক্ষণ থাকে না তবে কিডনীতে টফি (Tophi) জাতীয় প্রদাহ পরিলক্ষিত হয়। সাইনুভিয়াম ও অন্যান্য কলাতে গ্রানুলোমেটাস প্রদাহ হয়।
রোগ নির্ণয়: পোস্ট-মর্টেম তথ্যাদি: চক সদৃশ বস্তুর উপস্থিতি কিডনী, হ্নদপিন্ড, প্লীহা, পেরিটোনিয়াম ও যকৃতে।
হিস্টোপ্যাথলজি: ভিসেরাল গাউট: রেনাল টিবিউল সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয় ও ষ্ফীত ও Degenerated থাকে।
আর্টিকুলার গাউট: সাইনুভিয়াম ও অন্যান্য কলাতে গ্রানুলোমেটাস প্রদাহ হয়।
টক্সিন বিশ্লেষণ (HPLC, AAS, GLC, NIR): খাদ্যে বিদ্যমান টক্সিন বিশেষত অকরাটক্সিন ও সাইট্রিনিন এর উপস্থিতি বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে নিরূপন করতে হবে।
ভাইরাস পৃথকীকরণ (Virus Isolation): কিডনী হতে ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস এর নেফ্রোপ্যাথোজেনিক স্ট্রেইন (করোনা ভাইরাস) পৃথক করতে হবে।
পিসিআর, ডিএনএ Sequencing: পিসিআর (PCR) নির্ণয় এবং ডিএনএ Sequencing এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় সমন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়।
প্রতিরোধ:
১) ব্রুডিং অবস্থায় পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ সময়ে ১ থেকে ২ ঘন্টা বাচ্চাকে পানি খেতে দিতে হবে এবং এর পর প্রি র্স্টাটার খাদ্য প্রদান করতে হবে। পানির তাপমাত্রা সব সময় কক্ষ তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। শীতকাল হলে বাচ্চার ব্রুডিং দিনের বেলায় করতে হবে। ড্রিংকারের উচ্চতা যথাযথ হতে হবে। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিপল ড্রিংকিং এর হলে কিছুদিনের জন্য পানির কাপ ব্যবহার করতে হবে।
২) ব্রিডার ফার্ম ও হ্যাচারীতে বাৎসরিক চেক আপ এর মাধ্যমে মুরগীর রক্তে ইউরিক এসিডের স্বাভাবিক মাত্রা নির্ণয় করতে হবে।
৩) ব্রডিং অবস্থায় অধিক তাপমাত্রা প্রতিরোধ করা। বাচ্চা আসার পর প্রথম ১০ দিন লিটারের তাপমাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রথম ৩ দিন পর্যন্ত আর্দ্রতা ৬০% এর অধিক বা ৭০% পর্যন্ত বজায় রাখতে হবে।
৪) খাদ্যের সাথে অধিক সোডিয়াম বাইর্কাবনেট (প্রতি টন খাদ্যে ২ কেজির অধিক নয়) ব্যবহার না করা।
৫) খাদ্যে মাইকোটক্সিন প্রতিরোধের জন্য উন্নত মানের টক্সিন বাইন্ডার (যেমন Elitox, Mycofix plus) ব্যবহার করা।
৬) ভিটামিন এ নিয়মিত সরবরাহ করা।
৭) খাদ্যে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অনুপাত ঠিক রাখা। গ্রোয়ার খাদ্যে ফসফরাস লেভেল ০.৪৫-০.৫% এর মধ্যে রাখা উচিত।
৮) খাদ্যে মুরগীর বয়স ও জাত অনুযায়ী অনুমোদিত মাত্রার অধিক প্রোটিন ব্যবহার না করা। গাউট এর তীব্রতা অনুযায়ী প্রোটিনের মাত্রা ৩ থেকে ৫ দিন সীমিত রাখতে হবে।
৯) খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ থাকলে তা কমিয়ে লবণের মাত্রা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত খাদ্যে ০.৩% এর বেশি লবণ দেওয়া উচিত নয়।
১০) হ্যাচারীর ক্ষেত্রে বাচ্চা ধরা ও পরিবহনের প্রতিটি পর্যায়ে যতটুকু সম্ভব পানি শূন্যতা পরিহার করতে হবে।
১১) কিডনীর ক্ষতি করে এমন ধরনের ঔষধ একান্ত প্রয়োজন না হলে ব্যবহার না করা।
১২) ইউরিন এসিডাফায়ার ব্যবহার করা। এটি ইউরিনের অমøতা বাড়ায় এবং ইউরেটস বের করতে সাহায্য করে।
১৩) ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস এর ভ্যাকসিন কর্মসূচি মূল্যায়ন: যে সমস্ত এলাকাতে ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস এর প্রার্দূভাব রয়েছে সেখানে ৪ দিন বয়সে নেফ্রোট্রফিক স্ট্রেইন যুক্ত ভ্যাকসিন দিতে হবে।
১৪) গাউটে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্যালসিয়ামকে পাউডার রুপে সরবরাহ না করে গ্রিট আকারে ব্যবহার করতে হবে। যা ধীরে ধীরে ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে ফলে রক্তে ক্যালসিয়ামের একটি ভারসাম্য অবস্থা বিরাজ করে।
১৫) খাদ্যে ডিএল মিথিওনিন সরবরাহ করা হলে কিডনিকে নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কারণ দেখা গেছে যদি ০.৬% মিথিওনিন হাইড্রক্সি এনালগ খাদ্যে সরবরাহ করা হয় তাহলে মুত্রের অমøত্ব বেড়ে যায় ।
১৬) চিকিৎসার প্রয়োজনে কপার সালফেট ব্যবহার পরিহার
করতে হবে। যদি করতেই হয় তবে ভেটেরিনিয়ানের নির্দেশক্রমে ব্যবহার করতে হবে।
১৭) খাবারে প্রোটিনের পরিমাণ কমাতে হবে। ৩০% এর অধিক প্রোটিন গাউটের কারণ। প্রোটিন কমানোর জন্য ভূট্টার গুড়া আলাদাভাবে খাদ্যের সাথে মিশিয়ে কিছুদিন খাওয়াতে হবে।
গাউট রোগের চিকিৎসা: এভিয়ান গাউট পুরোপুরি নিরাময় যোগ্য নয়, ইউরিক এসিড এর নির্ধারিত মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা এবং এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া যাতে ইউরিক এসিড অধিকতর মাত্রায় বাড়তে না পারে।
১. প্রাথমিক অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে পানি এবং পানির পাত্র রাখতে হবে।
২. গাউটের চিকিৎসার মূলনীতি হল রক্তে ইউরিক এসিড এর লেভেল কমানো। এলুপিউরিনল (Allupurinol, যেমন Alurol, ACI Antigout) বা কোলচিচেইন (Colchicine) জাতীয় ঔষধ ২০-৪০ মিগ্রা প্রতি কেজি দৈহিক ওজন (১.৫ থেকে ২.৫ গ্রাম প্রতি লিটার) হিসাবে ব্যবহারে ইউরিক এসিড এর মাত্রা হ্রাস পায়। শরীরের কিছু প্রোটিন (পিউরিন) জেনথিন অক্সিডেজ নামক এনজাইম দ্বারা ভেঙ্গে ইউরিক এসিড নামক বাই প্রডাক্ট তৈরী হয়। রক্তে ইউরিক এসিড উচ্চ মাত্রায় পৌছাঁলে কিডনীতে পাথর হতে পারে। এলুপিউরিনল জেনথিন অক্সিডেজ এনজাইম এর কার্যকারিতাকে অবরুদ্ধ করে ইউরিক এসিড উৎপাদনে বাধা দেয়।
৩) মাইকোটক্সিন কিডনিকে নষ্ট করে দেয় তাই গাউটের চিকিৎসায় তরল টক্সিন বাইন্ডার (যেমন Mycoban, Toxynil plus, Aminotox-P) বা লিভার টনিক (যেমন Superliv/Upliv-H/Restoliv) ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
৪) যেখানে ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস রোগের প্রকোপ রয়েছে ষেখানে মুরগীকে ভ্যাকসিন প্রদান করতে হবে।
৫) প্রয়োজনীয় মাত্রায় অসমোলাইট যেমন- বিটাফিন/বিটামিন্ট/বিটামিউন ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
৬) পানিতে ভিটামিন এ, ডি৩, কে এবং বি কমপ্লেক্স ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায়।
৭) ইউরিন এসিডাফায়ার ব্যবহার: যেসব জিনিষ ইউরিনের এসিডিটি বাড়ায় তাদেরকেই ইউরিনারি এসিডিফায়ার বলা হয়। গাউট হলে কিডনিতে ক্রিস্টাল বা পাথর তৈরি হয় যা কিডনিকে নষ্ট করে দেয়। ইউরিনের এলকালিনিটি বেড়ে গেলে এসব ক্রিস্টাল বা পাথর তৈরি হয়। তাই ইউরিনের এসিডিটি বাড়িয়ে একদিকে নতুন ক্রিস্টাল তৈরি হওয়া প্রতিরোধ হবে এবং পাশাপাশি পুরনো ক্রিস্টাল বা পাথর গলিয়ে কিডনিকে কার্যকর করা হবে। নিম্নের যে কোন একটি ইউরিন এসিডাফায়ার খাদ্য বা পানিতে দেওয়া যেতে পারে। যেমন:-
ক) ভিনেগার: ১-২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা পযন্ত।
খ) পটাসিয়াম ক্লোরাইড: ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত।
গ) এমোনিয়াম ক্লোরাইড: ২.৫ কেজি প্রতি টন খাদ্য কমপক্ষে ৭ দিন।
ঘ) এমোনিয়াম সালফেট: ২.৫ কেজি প্রতি টন খাদ্য কমপক্ষে ৭ দিন।
৮) পানিতে ইলেকট্রোলাইট যুক্ত স্যালাইন (যেমন-Electrocare Plus) ব্যবহারে মৃত্যুহার কমাতে সহায়তা করে।
৯) ০.৬% মিথিওনিন হাইড্রক্সি এনালগ যুক্ত ফ্রি এসিড এর সাথে ৩% ক্যালসিয়াম ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
১০) খাদ্যে প্রাকৃতিক উদ্ভিজ উৎস, ফলমূল এবং ভিটামিন এ জাতীয় খাবার যেমন-গাজর, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, কচি ডাবের পানি ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
১১) চিনিতে মাত্র সুক্রোজ থাকে যা ভেঙ্গে গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ তৈরি হয়। ফ্রুক্টোজ ভেঙ্গে তৈরি হয় পিউরিন, আর পিউরিন থেকে তৈরী হয় ইউরিক এসিড। তাই গাউটের চিকিৎসায় চিনির বদলে গুড় ব্যবহার করা উচিত। গুড়ে তুলনামূলক কম সুক্রোজ থাকে, সাথে থাকে বিভিন্ন trace mineral (ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ), লবণ, বি ভিটামিন ইত্যাদি। কাজেই গুড় ইলেকট্রোলাইটের মত কাজ করে যা ইউরিক এসিড ক্রিস্টালকে ধুয়ে মুছে দেয়। প্রতি লিটারে ৫ গ্রাম গুড় দেওয়া যেতে পারে।
রেফারেন্স: 1) Vetcare bulletin, 2003. 2) Vamso biotec poultry health bulletin, May-June 2012.
লেখক: এজিএম, তামিম এগ্রো